সুইপোকা


অদ্ভুত এক প্রাণী। সারা বাড়ি তছনছ করে দিতে এদের জুড়ি নেই। কাঠের দরজা-জানালা, আলমারি, খাট, ড্রেসিং টেবিল, আলনা_ সব কেটে ছারখার করে দিতে পারে নিঃশব্দে। বলা হচ্ছে উইপোকার কথা। সেলুলোজ ছাড়া কিছু খায়ই না ওরা। ফলে কাঠের ওপর তাদের নির্ভর করতেই হয়। একমাত্র গাছের কাছেই সেলুলোজ পেতে পারে! তাই ওদের কাঠ খাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। উইরা বেশির ভাগই বে-রংয়া।
উইপোকার সমাজের গল্প শুনলে মনে হবে মানুষের মতো বুদ্ধিসুদ্ধি আছে ওদের। বিস্ময়কর হলেও সত্য আমাদের সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে ওদের সমাজের অনেক মিল। ওদের সমাজে আছে_ পুরুষ, স্ত্রী, কর্মী ও রক্ষক। কর্মী ও রক্ষকদের বংশবৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে কোনো অবদান নেই। অবদান নেই বলা ভুল, আসলে তাদের সে ক্ষমতাই নেই। এরা কেবল কাজ করে। এদের না আছে ডানা, না আছে চোখ। নিজেদের গা থেকে ফেরোমোন হরমোন বের করে গন্ধ সৃষ্টি করে আর সেই গন্ধ শুঁকেই সবাই কাজকর্ম চালায়। স্ত্রীর আর পুরুষ উইদের ডানা গজায় বছরের কোনো এক বিশেষ ঋতুতে। তখন আকাশে উড়তে উড়তে উভয়ের মধ্যে মন দেওয়া-নেওয়া হয়। ডানা খসিয়ে এরপর এরা নেমে আসে মাটিতে। শুরু হয় তাদের বংশবৃদ্ধির পালা। স্ত্রী উইয়ের প্রথম দিকের সমস্ত ডিম থেকে কর্মী আর রক্ষী উইপোকা জন্মাতে থাকে। তবে কর্মীর তুলনায় রক্ষীর সংখ্যা অনেক কম। সবচেয়ে বেশি জন্ম হয় কর্মী উইয়ের। স্ত্রী উই যতদিন ডিম পাড়তে থাকে ততদিন পুরুষ ও স্ত্রীকে রক্ষক উইয়েরা তাদের চারদিক থেকে পাহারা দেয় এমনভাবে, যাতে রানী বা স্ত্রী উইয়ের কোনোরকম অসুবিধা না হয়। রক্ষী উইদের মাথাটা থাকে বাইরের দিকে আর লেজটা ভেতরের দিকে, যাতে শত্রুর আক্রমণ হলেই তক্ষুণি তার মোকাবিলা করতে পারে। কারও কারও নাকের ডগায় খড়গের মতো অস্ত্র থাকে, কখনোবা এমন ক্ষমতাও থাকে যাতে শত্রু এলে তার দিকে অ্যাসিড জাতীয় তরল পদার্থ নিক্ষেপ করতে পারে। আবার কোনো কোনো রক্ষীর কামড়ানোর মতো শক্ত দাঁত জাতীয় অংশও থাকে। মূল উদ্দেশে রানীর যেন কোনো ক্ষতি না হয়। রানীর এই ঘরটিকে বলে রয়্যাল চেম্বার। পুরুষ বা রাজা উই রানীকে এ অবস্থায় ছেড়ে কোথাও যায় না। স্ত্রীকে রক্ষা করাই তার একমাত্র কাজ। রক্ষী উইরা কিন্তু খাবার জোগাড় করতে যায় না। এ দায়িত্বটা দেওয়া আছে কর্মীদের ওপর। কর্মীদের কাজের কথা বলে শেষ করা যায় না। এদেরও চোখ, পাখনা কিছু নেই। নেই বংশ বৃদ্ধির ক্ষমতাও। কিন্তু সারাটা দিন কী যে নিরলস পরিশ্রম করে এরা ভাবতেই পারবে না। খাবার-দাবার জোগাড় করে আনা, বাচ্চারা যারা ডিম থেকে বেরুচ্ছে তাদের খাওয়ানো-দাওয়ানো, বড় করে তোলা, শুধু তাই নয়, বলম্মীকে বাড়িয়ে তুলে ছড়িয়ে দেওয়া যাতে বংশবৃদ্ধির পর থাকার জায়গার অভাব না হয় এসবই কর্মী উইয়ের দায়িত্ব। এবার রানী মায়ের কথা বলি একটি বল্মীকে যখন উইপোকার সংখ্যা কুড়ি থেকে ত্রিশ হাজার কিংবা তাও ছাড়িয়ে যায় তখন রানী মা এক এক করে কিছু পুরুষ ও কিছু স্ত্রী উইও প্রসব করে। এসব স্ত্রী-পুরুষও পরবর্তীকালে ঠিক একইভাবে বংশবৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করে। প্রথম যে পিতামাতা তাদের বলা হয় প্রাইমারি পেয়ার, পরের যেসব স্ত্রী-পুরুষরা এলো তারা হয় সেকেন্ডারি পেয়ার। কখনো কখনো যদি এমন হয় কোনো দুর্ঘটনায় রয়্যাল চেম্বারের প্রাইমারি পেয়ার এর রাজা রানী মারা গেলেন তাহলে সে ক্ষেত্রে এই সেকেণ্ডারি পেয়ার সেই শূন্যস্থান পূরণ করে। আবার এমনও দেখা গেছে, রাজা রানী বেঁচে থাকা অবস্থায়ই তারা অন্য একটি বল্মীকে তৈরি করে, সেখানে একটি নিজস্ব রয়্যাল চেম্বার বানিয়ে নতুন করে তাদের জীবনযাপন এবং বংশবৃদ্ধি শুরু করল। আরেকটি মজার ব্যাপার হলো উইপোকা সেলুলোজ খায়, কিন্তু সেলুলোজ হজম করার মতো কোনো উন্নত ব্যবস্থা তাদের নেই। তাহলে কী করে হজম করে? ওদের পেটের ভেতর ওরা বাসা বাঁধতে দেয় এক ধরনের প্রোটোয়াকে। সেই প্রোটোয়া বা আদপ্রাণীটিই এই সেলুলোজকে ভেঙে জীর্ণ করার দায়িত্ব নিয়ে নেয়। আমাদের কাঠের জিনিস, দরজা-জানালা উইপোকা নষ্ট করে ঠিকই, সেটা তাদের বেঁচে থাকার তাগিদে। আবার দারুণ উপকারও করে ওরা। জঙ্গলের বিভিন্ন মরা গাছ থেকে যখন আহার সংগ্রহ করে তখন তারই ফাঁকে মরা কাঠকে এমন সব যৌগিক রাসায়নিক পদার্থে ভেঙে দেয় যার ফলে মাটিতে মিশে যাওয়া ওইসব পদার্থ থেকে নতুন প্রজন্মের গাছেরা তাদের খাদ্য উপাদান সংগ্রহ করে আর কিছু কিছু পদার্থ প্রকৃতির মধ্যে ফিরিয়ে দেয়, যার ফলে ভূ-রাসায়নিক চক্র তার আপন ছন্দে সঠিকভাবে পর্যায়ক্রমিক গতিতে এগিয়ে চলতে পারে।



0 Responses to "সুইপোকা"

Post a Comment

 

Sponsor

Return to top of page Copyright © 2010 | Flash News Converted into Blogger Template by HackTutors